তেল চিটচিটে রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার সহজ উপায়

তেল চিটচিটে রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার সহজ উপায়

রান্নাঘর যদি হয় অগোছালো তখন কি আর রান্নায় মন বসে? 

আর সেই জন‍্যেই আমাদের হতে হবে একটু কৌশলী এবং ধৈর্য‍্যশীল। কিচেন বা রান্নাঘরের সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে তেল চিটচিটে ও মশলাসহ মাছ-মাংসের গন্ধ, যা একেবারে অসহনীয়।

আমাদের দেশীয় রান্নার ঐতিহ্যে তেল আর মশলা মিশে আছে ওতোপ্রতোভাবে। এই দুই ছাড়া আমাদের রান্না যেন অসম্পূর্ণ। আমাদের খাবারের স্বাদে আরোও তৃপ্তির আনতে তেল এবং মশলা অপরিহার্য। 

কিন্তু এই মশলা আর তেল চিটচিটে রান্নাঘর পরিবেশের সাথে সাথে স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। যা আমরা অনেকেই জানি না। আবার জানলেও ঠিক কিভাবে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে হবে সেই উপায় জানি না।    

যদিও রান্নাঘরে আমাদের পরিবারের সদস্যের অনেকেই দিনের অর্ধেক সময় কাটাতে হয়। সেহেতু তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি আরোও বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন সেইসাথে স্বাস্থ্য ঝুকি যতটুকু সম্ভব কমানো উচিত। যা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক দুইক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।    

রান্নাঘরের তেল চটচটে ভাব ও আনুষঙ্গিক ময়লা পরিষ্কার করা সত্যিই খুব কষ্টসাধ‍্য এবং দুরহ ব‍্যাপার। যা আমরা সবাই কম বেশি জানি। তবে নিয়মমাফিক কিছু টিপস ও ট্রিকস মেনে চললে আপনি সহজেই এ থেকে পরিত্রাণ পাবেন।

এখন হয়তো ভাবছেন কিভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন? 

তাহলে আপনার জন‍্যেই সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের লেখাটি। রান্নাঘরের তেল চিটচিটের সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে আমরা নিয়ে এসেছি কয়েকটি কার্যকরি উপায়। দেরি না করে চলুন দেখে নিই। 

১. ভিনেগারের মিশ্রণ

রান্নাঘরকে ঝকঝকে পরিষ্কার করতে ব‍্যবহার করতে পারেন ভিনেগার এর মিশ্রণ। ভিনেগার এর মিশ্রণ তৈরির জন‍্যে প্রথমে একটি বাটিতে দুই কাপ গরম পানির সাথে দুই কাপ ভিনেগার ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এরপর একটি স্প্রে বোতল যোগাড় করুন। এবার মিশ্রণটিকে বোতলে ভরে বেশ কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে ভালোভাবে মিশাই। 

এবার একটি পরিষ্কার কাপড় নিয়ে তাতে ভিনেগার এর মিশ্রণটি নিয়ে তেল চিটচিটে জায়গাগুলোতে ঘষুন। বেশ কয়েকবার ঘষে ঘষে উঠানোর চেষ্টা করি। যদি দাগ খুব বেশি প্রগাঢ় না হয় তাহলে কিছুক্ষণের মধ‍্যেই দেখবেন চটচটে ভাব অনেকটাই উঠে এসেছে। এবার একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে দাগগুলো মুছে নিয়ে রান্নাঘরটিকে ভালোভাবে দাগমুক্ত করে নিই। 

২. ব্লিচিং পাউডার 

রান্নাঘরের তেল চটচটে ভাব দূর করতে ব্লিচিং পাউডারের কোন জুড়ি নেই। সপ্তাহে অন্তত একবার ব্লিচিং পাউডারের মিশ্রণ ব‍্যবহার করার চেষ্টা করুন। ব্লিচিং পাউডারে রয়েছে প্রাকৃতিক ব্লিচিং এজেন্ট যা তেল ঝোলের দাগের পাশাপাশি, জেদি ধরণের দাগ দূর করতেও সহায়তা করে থাকে। 

ব্লিচিং পাউডার ব‍্যবহারের জন‍্যে প্রথমে একটি বাটিতে তিন থেকে দুই চামচ ব্লিচিং পাউডার নিন। তাতে কিছু পানি মিশিয়ে একটি ঘন পেস্ট তৈরি করে নিন। তবে অবশ্যই ব্লিচ ব‍্যবহারের সময় হাতে দস্তানা ব‍্যবহার করতে ভুলবেন না। এতে করে আপনার হাতও থাকবে সুরক্ষিত। অন‍্যদিকে টাইলসের তেল চটচটে ভাব ও দূর হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ টাইলসে মিশ্রণটি ঢেলে অপেক্ষা করুন। এরপর জোরে জোরে ঘষে তেল চটচটে ভাব উঠিয়ে ফেলুন। আর দেখুন রান্নাঘর হবে প্রায়ই অনেকটাই নতুনের মতো। 

৩. বেকিং সোডা

খাবার সোডার কথা তো আমরা হরহামেশাই জানি। তবে এই খাবার সোডার মধ‍্যেও যে রয়েছে কিছু জাদুকরী উপকরণ তা কি আমরা জানি। বেকিং সোডা বা খাবার সোডার মাধ‍্যমেও সহজেই তেল চটচটে ভাব নিমিষেই দূর করে ফেলা সম্ভব। তার জন‍‍্যে আপনার লাগবে একটি বাটি, বেকিং সোডার সাথে পানি মিশিয়ে তৈরি করে নিন একটি ঘন পেস্ট। এবার এই মিশ্রণটিকে দাগযুক্ত জায়গায় লাগিয়ে দশ থেকে পনেরো মিনিট রেখে দিন। এরপর একটি ভেজা কাপড় দিয়ে জায়গাটি মুছে জায়গাটিকে একটি পুরনো ছোট টুথ ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে ফেলুন। ব‍্যস তাহলেই দেখুন কত সুন্দর ঝকঝকে রান্নাঘর আপনি পেয়ে যাচ্ছেন নিমিষেই। 

৪.ডিশওয়াশিং লিকুইড

রান্নাঘর এর থালাবাসনের সাথে সাথে ডিশওয়াশিং লিকুইড ব‍্যবহৃত হয়ে থাকে রান্নাঘরের তেল চিটচিটে ভাব কমাতে। তবে ডিশওয়াশিং লিকুইড ব‍্যবহারের আগে এর ব‍্যবহারবিধি সম্পর্কে জেনে নেওয়া উত্তম। ডিশওয়াশিং লিকুইড ব‍্যবহারের জন‍্যে প্রথমে একটি কন্টেইনার বা বাটিতে প্রয়োজনমত ডিশওয়াশিং লিকুইড নিয়ে তাতে পরিমাণ মতো পানি ব‍্যবহার করুন। এবার এই মিশ্রণটি দিয়ে চুলার আশপাশ, জানালার গ্রিলের কাছাকাছি তাক, মেঝেতে একটি পাতলা তারজালিতে মিশ্রণটি ডুবিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করুন। এতে করে দেখবেন রান্নাঘরের কর্ণার, তাক, আলনার কোণায় জমে থাকা কঠিন পুরু দাগ সহজেই দূর হয়ে যাচ্ছে। আর আপনিও পেয়ে যাচ্ছেন একটি উজ্জল, ঝলমলে রান্নাঘর। 

৫. লবণ ও গরম পানির মিশ্রণ

তেল চর্বিজাতীয় রান্নাঘর কে সুন্দর ও পরিপাটি রাখতে মাসে অন্তত একবার লবণ ও গরম পানির মিশ্রণ দিয়ে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সবার প্রথমে একটি পাত্রে ইষদষ্ণু পরিমাণ সহনীয় মাত্রার পানির সাথে লবণ মেশান। এবার একটি ন‍্যাকড়া পাত্রটিতে চুবিয়ে নিংড়ে নিন। এবার ন‍্যাকড়ার সাহায্যে পুরো রান্নাঘর ও রান্নাঘরের মেঝে ঘষে ঘষে দাগ তুলে ফেলুন। যেখানটাতে চর্বির পরিমাণ বেশি সেখানে আরেকটু গরম পানি ঢেলে, এরপর ঘষুন। এরপর আরেকটি পরিষ্কার কাপড় পুরো হেশেলটি পরিষ্কার করে নিন। 

৬. লেবু বা সাবান-পানি

লেবু সাবান পানি গোলা মিশ্রণও রান্নাঘর এর তেল চিটচিটে ভাব দূর করতে দারুন কার্যকরি। এর জন‍্যে আপনার লাগবে একটি পাত্র, আধা লিটারের মতো কুসুম গরম পানি, লেবু ও সাবান পানি। একটি গোটা লেবু কেটে নিয়ে সেটির রসগুলোকে সাবান পানির সাথে যোগ করুন। এবার লেবুর খোসাগুলো সংগ্রহ করুন। রান্নাঘরের যেসব প্রান্তে তেল মশলার ছিটা বেশি সেখানে বেশি বেশি মিশ্রণটি ছিটিয়ে দিন। এবার লেবুর খোসাগুলোকে লেবু-সাবান পানিতে চুবিয়ে তেল চিটচিটে যুক্ত জায়গাগুলোকে ঘষতে থাকুন। 

মেঝেতে ও যেখানে তেলের ছোট ছোট ছিটা রয়েছে সেখানে এই পদ্ধতিটি ব‍্যবহার করতে পারেন। সবগুলো জায়গা লেবুর খোসা দিয়ে ঘষা হয়ে গেলে। একটি পুরাতন ন‍্যাকড়া বা কাপড় মিশ্রণে চুবিয়ে পুরো রান্নাঘর টি মুছে ফেলুন। এরপর সাবান পানির ফেনা ভাব কাটাতে পুনরায় পরিষ্কার পানি দিয়ে রান্নাঘরটি ধুয়ে ফেলুন। 

৭। সাবান-পানি

হাতের কাছে যদি উপরের কোন ধরণের উপাদানই না খুঁজে পান তাহলে ব‍্যবহার করুন শুধুমাত্র সাবান গোলা পানি। কাপড় ধোঁয়ার কাজে ব‍্যবহৃত সাবান বা ডিটারজেন্টও এক্ষেত্রে অধিক কার্যকরি। কেননা কাপড় ধোঁয়ার কাজে ব‍্যবহৃত সাবানে ক্ষারের পরিমাণ বেশি। আর ক্ষার তেল চর্বির সাথে খুব দ্রুত বিক্রিয়া করে তা পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। উপরন্তু এ ধরণের সাবানে চটজলদি রান্নাঘরের তেল চিটচিটে ভাব দূর করাও সম্ভব। প্রথমে একটি বাটিতে আধা চামচ পরিমাণ সাবানের গুড়া বা গোলানো সাবান নিন। এরপর এতে গরম পানি যোগ করে মিশ্রণটিকে ভালোভাবে মিশিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজে ব‍্যবহার করুন। 

৮। বরফ 

রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজে আমাদের সর্বশেষ উপাদানটি হচ্ছে বরফ। শুনতে অবাক লাগলেও বরফও রান্নাঘর পরিষ্কারে কার্যকরি ভূমিকা পালন করে থাকে। এখন প্রশ্ন থাকতে পারে, কিভাবে? চলুন তবে জেনে নেই। 

বরফ মূলত রান্নাঘর থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ দূর করতে সহায়তা প্রদান করে থাকে। রান্নাঘরের সিঙ্ক বা অন‍্য যে কোন অংশ থেকে যদি আপনি এমন ধরণের গন্ধ পান তাহলে সবার প্রথমে একটি কন্টেইনার নিন। একটি কাগজী লেবুর আর্ধেক অংশ পরিমাণ রস নিয়ে তাতে কয়েকটি বরফ ডুবান। বরফের টুকরা গুলো পুরোপুরি রসের সাথে গলে যাওয়ার আগে মাছের আঁশতে যুক্ত স্থানে ঘষতে থাকুন। কয়েকবার এরকমটি করার পর কিছুক্ষণের মধ‍্যেই রান্নাঘরের বাজে গন্ধ আর আপনার নাকের ডগায় বিরক্তির তৈরি করবেনা। এছাড়াও লেবুর রসের পরিবর্তে ভিনেগারে কয়েকটি বরফের টুকরা ডুবিয়েও রান্নাঘরের গন্ধ দূর করতে পারবেন মূহুর্তেই। 

রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কিছু প্রয়োজনীয় টিপস- 

  • প্রতিদিন অন্তত একবার রান্নাঘরের আশপাশ, সেল্ফ, আলমারি পরিষ্কার করুন। যার জন‍্যে সাথে রাখতে পারেন বাসায় তৈরি ভিনেগার ও ডিশ ওয়াশারের সাসপেনশন। একই সাথে দুই থেকে তিন লিটার পরিমাণ সাসপেনশন(১:২) একটি স্প্রে বোতলে তৈরি করে নিলে অনেকদিন ব‍্যবহার করতে পারবেন। 

  • রান্নাঘরে ব‍্যবহৃত মশলার কৌটা, প্রয়োজনীয় আসবাব, বয়াম মাসে অন্তত একবার পরিষ্কার করুন। 

  • রান্নাঘর যদি টাইলসের তৈরি হয় তাহলে একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করুন প্রতিদিন। সেই সাথে ভিম বারের তৈরি লিকুইড সাসপেনশন দিয়েও মেঝের তেল ঝোল, কাঁচা বাজারের দাগ পরিষ্কার করে নিতে পারেন। 

  • রান্নাঘর এর সিঙ্ক এর দাগ তুলতে লেবুর সাথে বেকিং সোডা মিশিয়ে ব‍্যবহার করতে পারবেন। লেবু দিয়ে সিঙ্কের দাগ ঘষতে থাকুন। ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট টানা ঘষা হলে, সাবান অথবা সোডা দিয়ে ঢুয়ে ফেলুন। 

  • প্রতিদিন টাইলস ক্লিনার দিয়ে রান্নাঘরের বেসিনের পাইপ, সিঙ্কের পাইপ পরিষ্কার করতে পারেন। এতে করে পাইপে ময়লা জমে বিশ্রিও দেখাবেনা, রান্নাঘরও থাকবে পরিচ্ছন্ন। তবে পাইপের মধ‍্যে গরম পানি ঢালতে পারেন এতে করে সিঙ্কের সাথে এডজাস্টেড পাইপলাইন পরিষ্কার হয়ে যাবে নিমেষেই। 

  • রান্নাঘর এর জানালার গ্রিল, কাঁচ এর সাথে লেগে থাকা ঝুল পরিষ্কার করার জন‍্যে, প্রথমে জানালার ঝুলগুলো একটি ঝাড় দিয়ে ঝেড়ে নিন। এরপর হালকা কুসুম গরম পানিতে টাইলস ক্লিনার বা সাবানের গুড়া দিয়ে ভালোভাবে মেশান। এরপর একটি ধারালো মাজনি বা ফোম দিয়ে জানালার গ্রিলের সাথে এঁটে থাকা ময়লা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে ফেলুন। এবার একটি পরিষ্কার কাপড় কয়েকবার সাদা পানিতে নিংড়ে সাবানের ফেনা ভাব দূর করুন। একই পদ্ধতিতে জানালার কাঁচও পরিষ্কার করে ফেলুন। 

শেষ কথা 

রান্নাঘর পরিষ্কার করা যেমন বিরক্তিকর তেমনি কষ্টসাধ‍্য ব‍্যাপার। আজকাল ব‍্যস্ততম সময়ে অনেকেই এই ধরণের ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ পেতে কখনো কখনো এক্সপার্ট ক্লিনারের সাহায্য নিয়ে থাকেন। আপনি যদি চাকুরিজীবি হয়ে থাকেন তাহলে এ ধরণের সেবা গ্রহণ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে গুণতে হবে কিছু পরিমাণ বাড়তি খরচ। তবে পাকা গৃহিণীদের জন‍্যে আমি পরামর্শ দিবো প্রতিদিনের ময়লা-আর্বজনা প্রতিদিন ই পরিষ্কার করে ফেলুন। 

প্রতিদিন অন্তত চুলার চারপাশ, মেঝে, সেল্ফের আশপাশ সামান‍্য সাবানের গুড়া মিশ্রিত পানি দিয়ে ঘষে ঘষে ঢুয়ে ফেলুন। এতে করে আপনি যখন মাসিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দীর্ঘ পরিকল্পনা করবেন তখন দেখবেন কাজটা অনেকটাই আপনার কাছে সহজ মনে হবে এবং চটজলদি মিটিয়েও ফেলতে পারবেন। আর তেল চিটচিটে রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার জন‍্যে প্রয়োগ করুন আমাদের দেওয়া টিপসগুলো। আর দেখুন নিজের রান্নাঘর কতটা চকচকে ও তকতকে।

RELATED ARTICLES